বুড়িমা চকোলেট বোম আজও নস্টালজিক। আমরা সবাই ফাটিয়েছি।চলুন দেখে নিই তার ইতিহাস।
.
বাঙালি ব্যবসা করুক না করুক বেশ গাল ভরা কিছু বিদেশি শব্দ অবশ্য একদল বাঙালির মুখে মুখে – অঁতরপ্রেনার,ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট, এঞ্জেল ইনভেস্টর, স্টার্ট-আপ ইত্যাদি৷ কিন্তু তারও অনেক দিন আগে এক ভিটে ছেড়ে আসা এক উদ্বাস্তু মহিলা জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকতে থাকতে বাজি তৈরি করতে বসেছিলেন আর তাঁর চকলেট বোম এতই জনপ্রিয় হল যে নামই হয়ে গেল বুড়িমার চকলেট বোম৷
....
more... সে একটা দিন ছিল বুড়িমার। এক পুজো থেকে আর এক পুজো বারো মাসই চাপ আর চাপ। তবে লক্ষ্মীপুজোর পরে চাঁদ যত ছোট হয়ে আসত তত দম ফেলার ফুরসত্ থাকত না তাঁর। ডজন, ডজন বাজি চাই। শুধুই কালীপুজো নাকি! ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচেও তো 'বুড়িমা'-ই গর্জে উঠত।
.
ওনার আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস। জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের ফরিদপুরে৷ তারপর দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতার এক কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অন্নপূর্ণা দাস পরিণত হলেন অবশেষে বুড়িমা তে ।ছিন্নমূল অবস্থায় তিনি যখন এ পার বাংলায় এলেন তখন তিনি দিশেহারা চার সন্তানের জননী। তিন মেয়ে এক ছেলে। তবে বড় এবং মেজ মেয়ের বিয়ে হলেও ছোটো ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে যে এপার বাংলায় চলে আসেন । যদিও এমন সিদ্ধান্তে সায় ছিল না স্বামী সুরেন্দ্রনাথের। কিন্তু তাঁর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েও ছিলেন অন্নপূর্ণাও। ফলে স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯৪৮ সালে অবশেষে ভারত অভিমুখে যাত্রা। পশ্চিম দিনাজ পুরের ধলগিরি ক্যাম্প। সঙ্গে ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে। সুখের সংসার থেকে একেবারে রিফিউজি ক্যাম্পে। তখন সন্তানদের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতেন। কোনও দিন পটল, বেগুন, কুমড়ো , ঝিঙে কিনে বাজারে বিক্রি করা আবার কোনও দিন কর্মকারের কাছ থেকে হাতা , খুন্তি কিনে হাটে বিক্রি কিংবা বাড়ি বাড়ি নানান সামগ্রী ফেরি। সেই সময় গঙ্গারামপুরে পরিচয় হল সনাতন মণ্ডলের সঙ্গে। তাঁর ছিল মুদির দোকান অবশ্য তার সঙ্গে তিনি দক্ষ হাতে বিড়িও বাঁধতেন। অন্নপূর্ণা দেবীকে তিনি মা বলে সম্বোধন করেছিলেন নিজের হারানো মা কে ভুলতে। আর ধীরে ধীরে অন্নপূর্ণাদেবী সনাতনের কাছে শিখলেন বিড়ি বাঁধার কায়দা। অন্নপূর্ণার বিড়ি জনপ্রিয় হল। এই ভাবে চলতে চলতে বছর তিনেকের মধ্যে তিনি খুলে ফেললেন একটা বিড়ি তৈরির কারখানা।পাশাপাশি গড়ে উঠল তাঁর নিজস্ব পাকা বাড়িও। তবে অন্নপূর্ণার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে পড়তে লাগল সনাতনের ব্যবসা।তখন তিনি গঙ্গারামপুর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যান শ্বশুরবাড়ি শিলিগুড়িতে। তবে তার আগে অন্নপূর্ণাদেবীর ছোট মেয়ের জন্য একটা পাত্রও ঠিক করে দিয়ে গেলেন। পাত্রটি বেলুড়ের। বিয়ের পর নতুন জামাই বেলুড়ের প্যারীমোহন মুখার্জি স্ট্রীটে একটা দোকান সহ বাড়ির সন্ধান দেন, যার দাম ছিল তখন ন’শো টাকা। এই ভাবেই অন্নপূর্ণা দেবীর বেলুড়ে আসা এবং কলকাতার ব্যাপারী জগতের পীঠস্থান বড়বাজারে সঙ্গে যোগাযোগ।
বিড়ির সঙ্গে চলতে লাগল আরও নানা ধরনের ছোটখাটো জিনিসের ব্যবসা । এবার যোগাযোগ হল হরকুসুম গাঙ্গুলিকে। কিন্তু ইনি ব্রাহ্মণ সন্তান হওয়ায় তাঁকে সনাতনের মতো সহজে ছেলে বলে মেনে নিতে দ্বিধায় ছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী । তবে শোনা যায় বিভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন খোদ হরকুসুমই। তিনিই একদিন অন্নপূর্ণা দেবীকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে স্বীকার করিয়ে নিলেন ছেলে হিসেবে। এবার তাঁর কাছ থেকেও অন্নপূর্ণা দেবী শিখে নিলেন আলতা, সিঁদুর বানানোর কৌশল। যথারীতি অন্নপূর্ণা দেবী কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন আলতা -সিঁদুরে। অন্নপূর্ণা দেবী বুঝলেন মন দিয়ে করলে যে কোনও ব্যবসাতেই সফল হওয়া সম্ভব।ফলে বিভিন্ন মরশুমের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ঘুড়ি , দোলের সময় রঙ, স্বরস্বতী পুজোর সময় পুজো সামগ্রী এমনকি কালী পুজোর সময় অন্য জায়গা থেকে বাজি কিনে এনে বিক্রিও করতে শুরু করলেন। এভাবে দিন কাটতে লাগল আর বাজি বিক্রি করতে করতে তিনি খেয়াল করলেন কমবয়সীরা কিনতে এসে তাঁকে বুড়িমা বলে সম্বোধন করছে। তা শুনে দিনের শেষে অবাক অন্নপূর্ণা নিজেকে আয়নায় দেখলেন তাঁর চুলে কেমন পাক ধরেছে ৷বুঝলেন আক্ষরিক অর্থেই তিনি ‘বুড়িমা’ হয়ে গিয়েছেন । তাতেও উদ্যম না হারিয়ে আরও বেশি বেশি করে বাজি কিনে এনে দোকান ভরানোর ইচ্ছে হল। একহাজার টাকা ধার নিয়ে বড়বাজার থেকে বাজি এনে দোকান ভরালেন বিক্রির জন্য বুড়িমা । কিন্তু সেই সময় ব্যবসায় ধাক্কা খেলেন আইন না জানা থাকায়৷পুলিশ এসে জানতে চাইল বাজি বিক্রির সরকারি ছাড়পত্র কোথায়? লাইসেন্স না থাকায় সমস্ত বাজি বাজেয়াপ্ত হল। জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা সামলেছেন তাই এতে বিচলিত হলেন না বরং জেদ চাপল তাঁর৷ছাড়পত্র জোগাড় করে এবার নিজেই বাজির তৈরি করবেন ঠিক করলেন৷ওই বয়েসেও বাজি বানানোর পদ্ধতি জানতে বুঝতে হাওড়ার বাঁকরা, বজবজের নুঙ্গি চষে ফেললেন। এবার পরিচয় হল বাজি বিশেষজ্ঞ আকবর আলির৷ তাঁর কাছ থেকে শিখলেন সোরা , গন্ধক, বারুদের বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে বাজি তৈরি করতে আর পুরো মন দিলেন বাজিতেই৷তিনি এযুগের ম্যানেজমেন্ট গুরুদের মতো ব্র্যান্ডিং জানতেন না ঠিকই তবে নিজের বাজিকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে নাম দিলেন ‘বুড়িমা’ যেহেতু এই নামেই কচিকাঁচারা তাঁকে ডাকে৷ তারপর রাতারাতি তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন যেটা বানিয়ে, সেটা হল বুড়িমার চকলেট বোম ।
.
ধীরে ধীরে তিনি তালবান্দা আর ডানকুনিতে তৈরি করে ফেললেন আরও দুটো কারখানা।নিজে আরও বড় , আরও বড় কারখানা, আরও বড় ব্রাণ্ডিং – এর প্রয়োজনে পাড়ি দিলেন দক্ষিণ ভারতের বাজি শহর শিবকাশীতে । সেখানেই লিজে জমি নিয়ে দেশলাই কারখানা গড়লেন। ফলে রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে এবার বুড়িমার নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতবর্ষে । দীপাবলি আর কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে গেলো ‘বুড়িমা’র নাম। শব্দবাজিতে নিষেধাজ্ঞা এবং চিনাবাজি আগ্রাসন হয়তো বুড়িমার দাপট কমিয়েছে কিন্তু বুড়িমার নস্টালজিয়াকে মনে হয় না মুছতে পেরেছে ৷
.
তথ্যসূত্র : কলকাতা 24x7 ও এবেলা
#BanglaGolpo Series
please wait...Translate to EnglishLet's talk about the history of Budimaa's chocolate bombs. She was a lady who struggled through life and made delicious chocolate bombs. Despite being inundated with foreign words like venture capitalist, angel investor, start-up, she continued to make her baji. Her name was actually Annapurna Das and she lived in Faridpur, Bangladesh. But when she arrived in Bengal, she had to fight hard for independence. She had many obstacles but still continued to make her baji. Even during Lakshmi Pujo, she wanted to make more and more baji. She didn't just make baji for Kali Pujo, but for India-Pakistan cricket matches as well. She had four children and when she arrived in Bangladesh, she was in a difficult situation. But she continued to fight and make her baji.